সর্বশেষ

শিক্ষানবিশ আইনজীবী ও বার কাউন্সিল

কে এম মাহ্‌ফুজুর রহমান মিশু

বিজ্ঞ বিচারপতিদের কাছে মাঝে মধ্যেই শুনি- আদালতের দুটি ডানা। একটি বিচারক, অন্যটি আইনজীবী। কিন্তু আদালতের একটি ডানা যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি, অন্যটি নিরেট বাঁশের গাঁথুনি। তাহলে আমরা এগোবো কীভাবে? আদালতকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে যখন প্রায় সব আয়োজনই সম্পন্ন, তখনও বার কাউন্সিল যেন বাতির নিচে অন্ধকার।


বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মতো একটি সংস্থা পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশনের বদলে এখনও এনালগ কার্যক্রমে রয়েছে। ফলে পরীক্ষা ও ফল প্রকাশেও দেখা দিচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যেন বার কাউন্সিলে প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষানবিশের জন্য 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে এসেছে। এদিকে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী এমসিকিউ পরীক্ষার প্রতীক্ষায়। প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা মানতে না পারা বার কাউন্সিলের জন্য আদালত অবমাননার শামিল হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মানবিক বিবেচনায় শিক্ষানবিশ সনদ প্রদানের দাবি তো রয়েছেই।

বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী শিক্ষানবিশদের জন্য ছয় মাস পর পরীক্ষা গ্রহণ করার কথা থাকলেও আড়াই-তিন বছর লেগে যায়। বাংলাদেশের বাইরে কোথাও পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রতার এই পদ্ধতি আছে কিনা জানা নেই। এমতাবস্থায় মেধাবীরা এই মহান পেশার প্রতি আকৃষ্ট হবে কীভাবে? শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন সুখ-দুঃখের অবস্থা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করেছে। কিন্তু দেনদরবার করেও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না। অগত্যা ভার্চুয়াল আন্দোলনের পথই বেঁচে নিয়েছেন। আগামী ৩০ জুন ঢাকাসহ প্রত্যেক জেলায় আন্দোলন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে।

বর্তমানে পরিবারবর্গ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের এগিয়ে নিচ্ছে। এতে তাদের কী রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা বর্ণনাতীত। পৃথিবীর বহু প্রতিষ্ঠিত মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাহলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ৭০ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর নাস্তানুবাদ অবস্থা কেন? এসব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিগত ২০১৪ সালের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বনাম দারুল ইহসান মামলায় মাননীয় আপিলেট ডিভিশন ২০১৭ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন। মামলায় ১২টি নির্দেশনার সর্বশেষ নির্দেশনা ছিল- প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ধাপের পরীক্ষা সম্পন্ন করলেও অঘোষিত থেকে যায় লিখিত পরীক্ষার সিডিউল।

বার কাউন্সিলের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে যে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে তাতে বছর দুই-আড়াইয়ের আগে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ২০১৭ সালের প্রাথমিক ধাপ শেষে আড়াই মাসের লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল। এ ছাড়াও লিখিত খাতা নিরীক্ষার কাজ যেহেতু বিচারপতিরা করে থাকেন, তাই সেটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনিতেই লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে, সুতরাং এটি স্বল্প সময়ে নিরীক্ষিত হবে ভেবে নেওয়া অমূলক ব্যাপার। সামগ্রিক বিচারে ২০১৭ ও ২০২০ সালে প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণদের সনদ প্রদান করা কি অযৌক্তিক হবে?



২০১৮ সালে বার কাউন্সিলের নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুসারে আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার। ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রায় আট হাজার আইনজীবী তালিকাভুক্ত হন। ১৮ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যক আইনজীবী অপ্রতুল। আমাদের প্রতিবেশী দেশের আইনজীবী সংখ্যা ১২ লাখ। প্রতি বছর পরীক্ষায় পাসের হার ৭০ শতাংশ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বার কাউন্সিল বেশ কঠিনভাবেই আইনজীবী যাচাই-বাছাই করে।

একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা হতাশাজনক পরিস্থিতিতে শিক্ষানবিশদের ডুবে যেতে দিতে পারি না। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের হতাশার বেড়াজাল থেকে বের করতে বার কাউন্সিলকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আইন সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনানুযায়ী প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। করোনার সংকট মুহূর্তে মানবিক ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সনদ সমস্যার সুরাহা করতে হবে। বার কাউন্সিলকে দীর্ঘসূত্রতা ঝেড়ে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।

(সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত)

No comments