সর্বশেষ

মানব পাচার আইনের প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের উপায়

মো. জাকির হোসাইন

বর্তমানে সারাদেশে মানব পাচার ও মানব পাচারের বিচার নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। গত ২৮ মে, ২০২০ তারিখে লিবিয়ায় মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশি ২৬ জন নাগরিকসহ ৩০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলমান আছে। ইতিমধ্যে ২৬টি মামলা রুজু করা হয়েছে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ মানব পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক রুট হিসাবে স্বীকৃত।



প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ৬-৮ লক্ষ মানুষকে পাচার করা হয়। তার মধ্যে মহিলা ও শিশু প্রায় ৭৫ শতাংশ হয়। মানব পাচার নিয়ে এত কথা হলেও, দেশে মানব পাচারের মামলার বিচার ও শাস্তির অবস্থা খুবই খারাপ। অথচ ২০১২ সালে বাংলাদেশের অন্যতম একটি সেরা আইন হিসাবে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ কার্যকর করা হয়।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর ৩ ধারায় মানব পাচারের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত সংজ্ঞা অত্যন্ত ব্যাপক ও অর্থবহ। ধারার শেষে যে ব্যাখ্যা সংযোজন করা হয়েছে তা সংজ্ঞা কে পূর্ণাঙ্গ হতে সহায়তা করছে। এছাড়া ধারা ২(১০) মানব পাচারের শিকার ব্যক্তির সংজ্ঞা ও ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। এই আইনটি একটি বিশেষ আইন, যাহা একই সাথে অপরাধ ও বিচার পদ্ধতির বিষয়ে বিস্তারিত বিধান আছে। এই আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী আইনে বর্ণিত অপরাধ সমূহ আমলযোগ্য, অজামিনযোগ্য এবং অআপোষযোগ্য হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

আইনে মানব পাচারের ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের প্রতারণা, পতিতালয়ে কোন নারী বা শিশুকে ব্যবহার, বল বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আটক বা নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে বন্দি, কোন প্রকার শোষণ বা নিপীড়ন, জবরদস্তিমূলক শ্রম বা সেবা গ্রহণ, বিদেশে শ্রমিক প্রেরনের ক্ষেত্রে প্রতারণা ও মুক্তিপণ আদায়, ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা কে আইনে মানবপাচারের অপরাধ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। এই আইনের ৭ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন শাস্তি হিসাবে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অন্যূন ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া ধারা ৬, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ ধারায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবনসহ ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির কঠোর বিধান করা হয়েছে।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ অনুযায়ী, যে কোন ভিকটিম বা অন্য কোন ব্যক্তি মানব পাচারের বিষয়ে থানায় এবং ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করতে পারবেন। থানায় অভিযোগের ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে একটি প্রতিরোধমূলক অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন এবং তিনি এজাহার গ্রহণ করে নিয়মিত মামলার কার্যক্রম শুরু করবেন। এছাড়া অভিযোগ আকারে ট্রাইব্যুনালে ভিকটিম পক্ষ মামলা করতে পারবেন। এই আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসাবে প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পূর্ব পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট জেলার বা অধিক্ষেত্রের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকবেন। ২০১২ সালে এই আইন কার্যকর করা হলে ও ২০২০ সাল পর্যন্ত অথ্যাৎ গত ৮ বৎসরে কোন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।

গত ৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রংপুর বিভাগীয় জেলা ও মহানগরের জন্য ৭ টি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিমধ্যে গত ৮ মার্চ, ২০২০ তারিখে জেলা জজ পদমর্যাদার ৭ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়। দেশে বর্তমানে ১০১ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর অধিন প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার মামলার কার্যক্রম চলমান আছে। যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা অত্যধিক এবং উক্ত ট্রাইব্যুনাল সমূহ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে শিশু আদালতের প্রায় ৩০,০০০ মামলার দায়িত্বে আছে, তাই স্বাভাবিকভাবে উক্ত ট্রাইব্যুনাল সমূহ মানব পাচার মামলায় অধিকতর মনোযোগ দিতে পারে না।

গত ১০ জুন, ২০২০ তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকা ও গত ১৮ জুন, ২০২০ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকার তথ্যমতে যাহা পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যকে উদ্বৃত করে জানায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ১১,৪০০ জন পাচারের ঘটনায় ৬,১৩৪টি মানব পাচার মামলা রুজু হয়। ২০১৭ সালে মানব পাচারের মামলা হয় ৭৭৮টি, ২০১৮ সালে ৫৬১টি, ২০১৯ সালে ৬৮৫টি এবং ২০২০ সালে মে মাস পর্যন্ত ১০৬টি মামলা রুজু হয়। তারমধ্যে ২৩৩ টি মামলার বিচার কার্যক্রমে নিস্পত্তি হয়েছে ও ৫,৯০১ টি মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান আছে। বিচার শেষ হওয়া ২৩৩ টি মামলায় ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ২৯৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। সারাদেশে তালিকাভূক্ত মানব পাচারকারী আছেন ১০৬২ জন, যাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা আছে ও তার মধ্যে ৪৭০ জনের আন্তজার্তিক নেটওয়ার্ক আছে।

গত ১০ জুন, ২০২০ তারিখে বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার ৪টি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়া ও ভিকটিমকে মামলায় আপোষ করতে বাধ্য করা, মানব পাচার আইন ২০১২ সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা না থাকা, পৃথক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা না করা এবং চলমান মামলার কার্যক্রমের বিষয়ে কোন মনিটরিং সেল ও আন্ত:মন্ত্রণালয় এর সমন্বয় না থাকা উল্লেখযোগ্য। বিচার তরান্বিত করার জন্য সারাদেশের যে সকল জেলায় ও শহরে মানব পাচার মামলার হার অধিক সেখানে অনতিবিলম্বে পৃথক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হলেই বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। উদাহরণ হিসাবে কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে ৬৪২টি মামলা চলমান থাকলে ও সেখানে কোন পৃথক ট্রাইব্যুনাল নেই। এছাড়া যশোর, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, কুমিল্লা, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ জেলাসহ সীমান্তবর্তী জেলা সমূহের মানব পাচার মামলার পরিমাণ অনেক বেশি হলেও সেখানে পৃথক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

এই আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী পুলিশ ৯০ দিনের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে আরো ৩০ দিন বর্ধিত সহ ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করার বাধ্যবাধকতা আছে। ২৪ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশনা আছে। ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম শেষ না হলে ১০ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা সহ সুপ্রীম কোর্ট কে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা আছে। আইনের ২২(৫) ধারা মোতাবেক আসামির জামিনের বিষয়টিকে অধিকতর কঠিন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধের তীব্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা এবং আসামির অপরাধের পূর্ব ইতিহাস বিবেচনাক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শুনে আদেশে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখপূর্বক জামিন দিতে পারবেন। প্রচলিত অন্যান্য আইনে জামিনের ক্ষেত্রে এরুপ শর্ত আরোপ করা হয়নি।

এই আইনের কয়েকটি দিক খুবই উল্লেখযোগ্য এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও সাক্ষ্য আইনের ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক সূচনা। আইনে ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার বিষয়ে বিস্তারিত বিধান আছে ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আর্ন্তজাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার বিষয়ে আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইন নির্ধারিত যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন। এই আইনটি একটি প্রগতিশীল ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের হাতিয়ার হিসাবে ভিকটিম ও সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ট্রাইব্যুনাাল যদি মনে করে তবে ভিকটিম ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল এর মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবেন এবং ক্যামরাট্রায়াল (রুদ্ধকক্ষ) এর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন। ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার স্বার্থে মামলা চলাকালীন যে কোন সময় যেকোন পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারবেন। উক্ত আইনে ৩০ ধারা মোতাবেক যেকোন অডিও, ভিডিও বা ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারণকৃত কোন প্রমাণ সাক্ষ্য হিসাবে ট্রাইব্যুনালে গৃহিত হবে।

মানব পাচার মামলার বিচার চলাকালে ভিকটিম বা বাদিপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আসামির যেকোন সম্পত্তির বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনাল দিতে পারবে। এছাড়া মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত অর্থদণ্ড ক্ষতিপূরণ হিসাবে ভিকটিমকে প্রদানের নির্দেশ দিতে পারবে। যদি ট্রাইব্যুনাল মনে করে ভিকটিমের আরো অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারবে এবং রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে উক্ত অর্থ আসামির নিকট হতে আদায়পূর্বক ভিকটিমকে প্রদান করবে। এই আইনকে কার্যকর করার লক্ষ্যে আইনের ১৯ ধারা মোতাবেক মানব পাচার মামলার সমন্বয় ও তদন্তের তদারকি করার উদ্দেশ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশ আছে। এছাড়া ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা ও পূর্ণবাসনের লক্ষ্যে একটি মানব পাচার প্রতিরোধ তহবিল গঠনের বিষয়ের নির্দেশনা আছে।

উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি প্রকৃষ্ট আইন। কিন্তু দীর্ঘ ৮ বৎসরে ও ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া, মামলার কার্যক্রম তদারকি না করা, আদালতে ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়া এবং ট্রাইব্যুনালে ভিকটিম ও সাক্ষীকে উপস্থাপন না করায় বিচারের অন্তরায় বলে প্রতিয়মান হয়। মানব পাচার মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে অবিলম্বে আরো ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা এবং মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর সমন্বয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর মনিটরিং সেল গঠন আবশ্যক। তবেই বাংলাদেশ মানব পাচার রোধকল্পে একটি কার্যকর বার্তা অপরাধীচক্রকে দিতে পারবে।

(চ্যানেল আই অনলাইনে প্রকাশিত)

No comments