মুসলিম বিবাহের শর্ত, যোগ্যতা ও প্রকারভেদ

ইসলামের দৃষ্টিতে নর-নারীর মধ্যে জৈবিক চাহিদা পুরণের জন্য ও সন্তান জন্মদানের জন্য বিবাহ করাকে হালাল এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন-সম্পর্ককে হারাম করা হয়েছে। মুসলিম আইনে বিবাহ এক ধরণের দেওয়ানী চুক্তি।

বিবাহ শব্দটি আরবী নিকাহ শব্দ থেকে আগত যার অর্থ একত্রে অংশগ্রহণ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো— তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত :২১)


মুসলিম বিবাহের আইনগত শর্ত

ইজাব বা প্রস্তাবনা
এটি হচ্ছে বরের কাছে মেয়ের অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব উপস্থান করা। যেমন, ‘আমি অমুককে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম’ অথবা এ ধরনের অন্য কোনভাবে প্রস্তাব পেশ করা।

কবুল বা গ্রহণ করা
বর - কনের স্বাধীন সম্মতি থাকতে হবে । অর্থাৎ সম্মতির কথাটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে হবে । যেমন, ‘আমি কবুল বা গ্রহণ করলাম’ ইত্যাদি।

সাক্ষী
প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের ২ জন সাক্ষী থাকতে হবে।  ভুল ধারণা প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে যে, একজন পুরুষ সাক্ষী সমান দুইজন নারী সাক্ষী । সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে চুক্তির ক্ষেত্রে নারী - পুরুষের সমান মর্যাদা । কাবিননামার ফর্মেও কোথাও একজন পুরুষ সাক্ষীর বিপরীতে দুইজন নারী সাক্ষীর কথা বলা হয়নি । এছাড়া ‘ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ ’ বা ‘ মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪ ’ বা অন্য কোন আইনে।

দেনমোহর
প্রতিটি মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর থাকতে হবে । মোহরানা স্ত্রীর অধিকার। প্রতিটি পুরুষ স্ত্রীর আর্থ সামজিক অবস্থা বিবেচনা করে দেনমোহর প্রদান করবেন।


মুসলিম বিবাহের আইনগত যোগ্যতা

মুসলিম আইনে বিবাহ বয়স সাবালকত্ব ও বয়ঃসন্ধি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের আইনে বিবাহের নির্দিষ্ট বয়স নির্ধারন করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী বিবাহ করার জন্য একজন ছেলের বয়স হতে হবে সর্বনিন্ম ২১ (একুশ) বছর এবং একজন মেয়ের বয়স হতে হবে সর্বনিন্ম ১৮ (আঠারো) বছর। এর কম বয়সে বিবাহ করা বাল্য বিবাহ।

বাল্যবিবাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।

বিবাহের প্রকারভেদ

ক) বৈধ বিবাহ
মুসলিম আইনের সকল বিধি বিধান মেনে যে বিবাহ করা হয় তাকে বৈধ বিবাহ বলে।

খ) বাতিল বিবাহ
যে বিবাহ আইনসঙ্গত নয় বা যা অবৈধ তাই বাতিল বিবাহ। যেমন, রক্তসম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কের কাউকে বিয়ে করা।

গ) অনিয়মিত বিবাহ
যে বিবাহে আইনগত ত্রুটি থাকে এবং সেই ত্রুটি সংশোধন করা হলে বিবাহ বৈধ হয় তাকে অনিয়মিত বিবাহ বলে।
যেমনঃ
- সাক্ষী ছাড়া বিবাহ করলে
- ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিবাহ করলে
- ইদ্দত পালনের সময় কাউকে বিবাহ করলে
- ৪র্থ স্ত্রী থাকাকালীন ৫ম বিবাহ করলে
- সহোদর ২ বোনকে বিবাহ করলে

বিবাহ রেজিস্ট্রেশন

মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪ (Muslim Marriage and Divorce (Registration) Act, 1974),এর বিধান মতে প্রত্যেকটি বিবাহ নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক।

মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে একজন বিবাহ রেজিস্ট্রার দেনমোহরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে একটি বিবাহের রেজিস্ট্রেশনের ফি নির্ধারণ করে থাকেন। ধার্য্যকৃত দেনমোহরের প্রতি হাজার বা তার অংশবিশেষের জন্য ১০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি। তবে রেজিস্ট্রেশন ফি এর পরিমান ১০০ টাকার কম হবে না এবং ৪০০০ টাকার উপরে হবে না।

যেমনঃ কারো বিবাহের দেনমোহর ১০,০০০ টাকা হলে ফি হবে ১০০ টাকা, ১০,৫০১ টাকা হলে ১১০ টাকা (প্রতি হাজারের অংশবিশেষের জন্যও ১০ টাকা), ১১,০০০ টাকা হলেও ১১০ টাকা, দেনমোহরের পরিমান ৫০০,০০০ টাকা হলেও ৪০০০ টাকা (সর্বোচ্চ পরিমান ৪০০০ টাকা) আবার দেনমোহর ১০০০ টাকা হলেও ফি দিতে হবে ১০০ টাকা (যেহেতু সর্বনিম্ন পরিমান ১০০ টাকা)।


কোর্ট ম্যারেজ ( Court Marriage )

এই বঙ্গীয় ব- দ্বীপে নানা রঙের আবেগ, সংস্কার, কুসংস্কার, প্রথা , ধারনার চাষাবাদ হয় । তেমনি একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে । মনে করা হয় কোর্টে গিয়ে বিয়ে করা মানেই কোর্ট ম্যারেজ । বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ বা নোটারী পাবলিক মহোদয়কে বিয়ে নিবন্ধনের কোন ক্ষমতা সরকার অর্পণ করেনি । এই ক্ষমতা একমাত্র নিকাহ রেজিস্টারের । কোর্টে গিয়ে আসলে যেটা করা হয় তা হলো বিবাহ করতে ইচ্ছুক ছেলে - মেয়ে , ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিকের সামনে হলফনামা বা এফিডেভিট করে । এই ধরণের এফিডেভিট কোর্টে না গিয়ে নোটারী পাবলিকের চেম্বারে গিয়েও করা যেতে পারে । হলফনামায় পক্ষদ্বয়ের পরিচয়সহ সম্মতির বর্ণনা থাকে । মানে হলো তারা বিয়ে করতে ইচ্ছুক । হলফনামাটি সম্পাদিত হওয়া মাত্র একটি মূল্যবান দলিলে পরিণত হয় । মূলত অপহরণসহ বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমার হাত থেকে রেহাই পেতে এই হলফনামা সহায়ক হয় । অনেক ক্ষেত্রে ছেলে - মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক পারিবারিকভাবে স্বীকৃত হয় না । মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় । এমনো দেখা গেছে প্রেমিক যুগল ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ছেলের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা দেওয়া হয়েছে । পরবর্তীতে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে তাকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করে ছেলের বিরুদ্ধে অপহরণের মিথ্যে সাক্ষ্য দিইয়ে জেল খাটানো হয়েছে । বা পালিয়ে বিয়ে করে ফেললেও পরবর্তীতে মেয়েকে দিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার চেষ্টা করানো হয় যে, ছেলেটি সম্মতি ব্যতিরেকে জোর করে তাকে বিয়ে করেছে । এসব পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে সম্মতির ঘোষণা সম্বলিত এফিডেভিট অত্যন্ত কার্যকর । কিন্তু মনে রাখতে হবে সম্মতির ঘোষণা সম্বলিত এফিডেভিট মানে কোর্ট ম্যারেজ নয় । এফিডেভিট করার পর কাজীর কাছে বিবাহ নিবন্ধন করা না হলে তা বৈধ বিয়ের শর্ত পূরণ করে না । বিয়ে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কাজীর কাছে নিবন্ধিত কাবিননামা বিয়ের মূল দলিল ।



মন্তব্য লিখুন