সর্বশেষ

সাংবাদিকতার প্রতিকূলতা


এম এ আহাদ
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দুবার বড় ধরণের লোভনীয় অফার আমি পাই। একবার একজন অ্যাসিল্যান্ডের কাছ থেকে আরেকবার একটা ব্যাংক থেকে। সিলেটের একটি উপজেলার ভূমি অফিসে প্রতিবেদন করতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ণীতির খবর বেরিয়ে আসে। এ নিউজ যেন প্রচার না করি সেজন্য ওই উপজেলার অ্যাসিল্যান্ড আমাকে বড় অংকের অর্থ অফার করেন। ১০ লাখ! তখন আমার বেতন ছিল মাত্র ২৫ হাজার। তারপরও সংবাদটি হা্ইড করিনি। লোভ-লালসা আমার কাছে পরাজিত হয়েছে সেবার। যেদিন সংবাদ প্রচার হয় সেদিনই এই অ্যাসিল্যান্ডকে বদলি করা হয়। 

পরের অফার আসে একটা ব্যাংক থেকে। আমার কাছে খবর আসে একটা ব্যাংকের কর্মকর্তা তার শাখা থেকে একজন প্রবাসীর একাউন্টের বেশ কিছু টাকা তুলে নিয়েছেন। খবরের পেছনে ছুটে দেখি শুধু একজনের একাউন্ট নয়, বহু মানুষের একাউন্ট থেকে এভাবে টাকা তুলেছেন তিনি। আরও খবর আসে শুধু এই শাখা নয়, এই ব্যাংকের আরও কয়েকটি শাখায় কর্মকর্তারা তাদের গ্রাহকের একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। এসব গ্রাহক প্রবাসী।

তখন আমাদের গাড়ি ছিলনা। সহকর্মী নৌসাদ আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে বাইকে করে ছুটে যাই সেই উপজেলায়। সেই ব্যাংকে প্রবেশ করি। কিন্তু ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাদের ম্যানেজ করতে ব্যস্ত। তারা অনুরোধ করেন সংবাদটি যেন না করি। সিলেট থেকে ছুটে যান ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান। রিকুয়েস্টের পর রিকুয়েস্ট। ঢাকা থেকে ব্যাংকের পিআরও শাখার কর্মকর্তা কল দেন। রিকুয়েস্ট করেন। আমাকে বলেন, আহাদ আপনার চ্যানেলের মালিকের সাথে আমি ওমুক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি এক সময়। নিউজটা করো না প্লিজ। তারপর এই ব্যাংকের এমডি কল দেন। রিকুয়েস্ট করেন। সিলেট থেকে এক সাংবাদিক বড় ভাই কল দিয়ে রিকুয়েস্ট করেন নিউজটা না করতে।

এত অনুরোধের পরও যখন আমাকে নড়ানো যায়নি তখন ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা বলেন, আহাদ সাহেব আপনি বেতন কতো পান। তখন আমি ৪০ হাজারের মতো পেতাম। বললাম এই সংখ্যা। বললেন এই টাকা দিয়ে কি হবে। আপনি বরং আমাদের ব্যাংকে আরও বড় বেতনে চাকরি নিতে পারেন। আমরা ব্যবস্থা করবো। বললাম আমি সাংবাদিকতায় ভালোই আছি। তারপর তিনি বললেন তাহলে আপনার ভাই-বোন কাউকে আমরা চাকরি দিয়ে দেব। বললাম আমার পরিবারে চাকরি করার মতো কেউ নেই। তারপর বললেন চাইলে আমরা আপনাকে একটা গাড়ি, ফ্ল্যাট দিয়ে দেব। আপনার জীবনে উপকার হবে। আমাদেরও উপকার হয়ে গেল। 

তারপর তিনি তুলে ধরলেন ব্যাংকের অবস্থা। বললেন গ্রাহকের একাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলনের ঘটনায় আমরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে। এই ঘটনা যে সব গ্রাহকরা জানেন তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। আমাদের সিলেটের সবগুলো শাখার অবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে আপনার সংবাদ প্রচার হলে সারা দেশে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আমরা দেওলিয়া হয়ে যাব। আমরা যারা চাকরি করি তাদের চাকরি চলে যাবে। সবাই বেকার হয়ে যাব। প্লিজ আপনি নিউজটা বন্ধ করে দেন। 

তিনি আরও বললেন, আমাদের যেসব অফিসার এসব দুর্ণীতির সাথে জড়িত তাদেরকে আমরা সাসপেন্ড করেছি। আমরা শাস্তি দিয়েছি। দুজন এখন কারাগারে আছেন।

তাদের এতো আকুতি মিনতি কিংবা লোভনীয় অফার আমাকে দুর্বাল করতে পারেনি। কিন্ত চাইলেই এই নিউজটা আমি কিল করতে পারতাম। কারণ এটা কোন অফিস অ্যাসাইমেন্ট ছিলনা। আমি যে নিউজ করবো সেটাও জানতো না আমাদের অফিস। তখন প্যাকেজ করলে ইকু ভাইকেও বলতে হতোনা। উনি সেই স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছিলেন। আর আমাদের মধ্যে পেশাগত কম্পিটিশন থাকায় একজন আরেকজনের সাথে ভালো কোন প্যাকেজের বিষয় শেয়ার করতাম না সাধারণত। ভাবতাম এটা আমিই করবো। তাই এই নিউজের বিষয়ে ঢাকা কিংবা সিলেটের কেউ জানতেন না। শুধু জানতেন চিত্র সাংবাদিক নৌসাদ ভাই। এজন্য চাইলেই নিউজটি কিল করে ব্যাংকের লোভনীয় অফার নিয়ে নিতে পারতাম। কেউ হয়তো বিষয়টি জানতেনই না।

যাক সে কথা। বিকেলে নিউজ করলাম। সন্ধ্যায় স্ক্রিপ্ট এডিট হয়ে চলে এলো। নিউজরুম এডিটর ফোন দিয়ে বললেন, আহাদ ভাই দ্রুত ভয়েস দেন, এটা কাল যাবে। আমিও ভয়েস দিলাম।

কিন্তু পরদিন নিউজ গায়েব! সেদিন শুক্রবার ছিল। জুমার নামাজ পড়ে বের হয়েছি এমন সময় অফিসের বড় এক ভাইয়ের কল। বললেন আহাদ নিউজটা নিয়ে কি যে সমস্যা গেছে কাল রাতে! তুই আমাকে কি যে পেরেশানিতে ফেলেছিলে। তারপর বললেন, উপর মানে অনেক উপরের নির্দেশে নিউজটি আটকে দেয়া হয়েছে। 

পরে জানলাম নিউজরুম, পরিচালবৃন্দ কিংবা এমডি কেউ নিউজ আটকাননি। আটকেছে আরও উপর থেকে----

এ ভাই পরে পরামর্শ দেন তুই অন্য চ্যানেলকে নিউজটা দিয়ে দিতে পারিস! কিংবা কারও ফেসবুকে------!

রাগে ক্ষোভে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলাম....

লেখক
সিনিয়র রিপোর্টার 
সময় টিভি

[আপনিও মতামত বিভাগে লেখা পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠাতে ইমেইল করুন ain24team@gmail.com ।]

মন্তব্য লিখুন