সর্বশেষ

সাংবাদিকতা বনাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন | ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্ব ২

নাজমুল হোসাইন পাপ্পু

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা হচ্ছে সমাজের দর্পনস্বরুপ । দর্পন দিয়ে যেমন মানুষ তার চেহারা দেখে তেমনি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মাধ্যমে দেশের চলমান অসঙ্গতি, দূর্নীতি,সামাজিক অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরে।সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে।সেযুগের নজরুল থেকে বর্তমানে ইমদাদুল হক মিলন বা আনিসুল হক  সাহেব সাংবাদিকতায় আলো ছড়াচ্ছেন । তারা সাহিত্যে যেমন আলো ছড়িয়েছেন তেমনি সাংবাদিকতায় ও রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা।


কিন্তু বর্তমান সময়ের সংবাদপত্র  একটি ক্রান্তিলগ্ন পার করছে।  যার অন্যতম কারণ  ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট,২০১৮ বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের কিছু বিধান আছে যা মুক্ত এবং নিরপেক্ষ  সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ।  যা অনুসন্ধানমূলক বা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করাকেও বাধা প্রদান করে যেখানে গঠনমুলক সমালোচনা বা freedom of speech সাংবিধানিক  এবং গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু কলামিস্ট থেকে কার্টুনিস্ট কিংবা ব্লগার(যারা গঠনমূলক সমালোচনা করে) থেকে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক কেউ বাদ যাচ্ছে না এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে।

মূলত এই আইনের ধারা ২৬,২৯,৩১ এবং ৩২ হচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার অন্যতম বাধা। যেখানে ধারা ৩২ কে বিবেচনা করা হয় তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের সেই ৫৭ ধারার চেয়ে ও ভয়ংকর।

প্রথমে সংবিধানে যাচ্ছি এখানে ৩৯ তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

যেহেতু সংবিধান দেশের Mother of all Law তাই এটি অখন্ডনীয়।
অর্থ্যাৎ স্বয়ং সংবিধান freedom of speech এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে।

এখন আসা যাক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। ধারা ২৬ এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের মাথার উপর দিয়ে প্রথম ছক্কাটা হাকাতে চেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে অনুমতি ব্যতীত কোনো তথ্য সংগ্রহ বা ব্যবহার করা যাবে না।(প্রথমবার করলে ৫ বছর ২ য় বা করলে ৭ বছরের সাজা সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা )

আপনার প্রশ্ন হলো অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতায় কী পরিচয় দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে?
রাষ্ট্রের বিভিন্ন অফিসে যারা লুটপাট, দূর্নীতি, সরকারের দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে যারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের এই ধারাটি দিয়ে এদেরকে প্রোটেকশন দেওয়া হচ্ছে না? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
এরপর আসছে ধারা ২৯ যেখানে বলা হয়েছে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করার ব্যাপারে।যেহেতু সাংবাদিকরা সমাজের অসংগতি, অন্যায়, অবিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরেন এবং সকলের সামনে অপরাধীর মুখোশ উন্মোচন করতে সাহায্য করেন সেখানে তো অপরাধী হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন তো হবেই।

তো এখানে এই ধারাটি কী উক্ত সাংবাদিককে অপরাধীর আক্রোশের শিকার হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
যেহেতু আমাদের আদালত Literal interpretation ফলো করে সেক্ষেত্রে মানহানির দায়ে আটক হওয়া সাংবাদিককে সেটি প্রমাণ করতে করতেই তো তার আলো নিভে যাবে।

এরপর আসছে ভয়ংকরতম ধারা ৩২. সেটি তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার নতুন রুপ।যেটি মুক্ত সাংবাদিকতার টুটি চেপে ধরেছে।যেটি ৫৭ ধারার চেয়েও ভয়ংকর। যেখানে সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দন্ডের কথা বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস,কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্যকোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ করে তাহলে তিনি ১৪ বছরের সাজা বা ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। আবার যদি পুনরায় করেন তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। 

এই ধারায় মূলত Official Secrets Act, 1923 এর ঘাড়ে বন্ধুক রেখে সাংবাদিক কে শিকার করার মতো। বলা যায়  ধরি মাছ না ছুই পানি টাইপের। অর্থ্যাৎ এই ধারাটির স্পিরিট মূলত সরকারি কোনো অফিসের ঘুষ, দূর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার যেনো জনগণের সামনে না নিয়ে আসতে পারে এবং অফিসে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে যেনো কোনো অনুসন্ধান চালাতে না পারে সেটি থেকে prevent করে।যেটি মূলত একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার  চর্চায় চরম বাধা।

এই ধারাটির জন্য রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভের অকাল প্রয়াণ ঘটছে এবং ঘটবে।কোনো মানুষ এমন সব ধারার সাজা মাথায় নিয়ে সাংবাদিকতা করতে উৎসাহ পাবেন না।
একটা প্রবাদ আছে "ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম   সর্দার"
সাংবাদিকতা প্রফেশনটা অনেকটাই এরকম।  তারা দেশের সকল অপরাধ,অন্যায়, অসংগতি, ক্ষমতার অপব্যবহার  জণগণ ও সরকারের সামনে তুলে আনেন কিন্তু দিন শেষে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখার জন্য এমন কিছু বিধান রাখা হয়েছে যা নিরপেক্ষ ও মুক্ত সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
এখন যদি সংবিধান দিয়ে যাস্টিফাই করতে চাই তাহলে যেহেতু সংবিধান হচ্ছে সকল আইনের উৎস এবং সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে আবার ২৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে ও বলা আছে

২৬। (১) তৃতীয় ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
অর্থাৎ সংবিধানে ও বলা আছে যদি সংবিধানের সাথে কোনো আইন inconsistent হয় তাহলে যতটুকু আইন inconsistent ততটুকু বাতিল হবে।

তাই রাষ্ট্রকে আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কতিপয় ধারা নিয়ে আবার ভাবা উচিত।

লেখক
ছাত্র
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
আইন বিভাগ (তৃতীয় বর্ষ)

No comments