সর্বশেষ

৭ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি কোন মামলা

হাবিব রহমান

১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদ অনুমোদন করে বাংলাদেশ। এরও ১৫ বছর পর ২০১৩ সালে এ সনদের আলোকে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হয়। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ করা এবং ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এ আইন প্রণয়ন করা হলেও দীর্ঘ ৭ বছরেও এ পর্যন্ত এ আইনের অধীনে কোনো মামলার সুরাহা হয়নি। হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগের বিপরীতে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭টি। অধিকাংশ সময় ভুক্তভোগী বা তার পরিবার নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মামলা থেকে বিরত থাকেন। এমতাবস্থায় আজ শুক্রবার ২৬ জুন পালিত হতে যাচ্ছে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবস-২০২০।


মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যারা সাহস করে মামলা করেছেন তারা নানা পর্যায়ে হয়রানি ও হুমকি শিকার হচ্ছেন, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন। এ আইনের দায়েরকৃত প্রথম মামলাজনিত হত্যা মামলা এখনো বিচারাধীন। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগগুলো নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে কিংবা বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ দেশে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) আজ অনলাইনে এ বিষয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) দাবি জানিয়েছে, সকল প্রকার নির্যাতন, বেআইনি আটক ও হত্যা বন্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার এবং এ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির প্রদত্ত সুপারিশগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, ‘হেফাজতে নির্যাতনবিরোধী আইনটি করা হয়েছে ঠিক কিন্তু রাষ্ট্র নিজেই এই ব্যাপারে অনাগ্রহী। একটি অবস্থায় তারা আইনটি করেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্যদের কাছে রাষ্ট্র এক ধরনের আত্মসমর্পণ করেছে, যার কারণে দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে নতুন মামলাও হচ্ছে না এবং যেসব মামলা হয়েছে তার একটিরও এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। বরং আমরা দেখেছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে সরকারের কাছে বারবার আইনটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছে। তার মানে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক ধরনের সুবিধা নিতে চাইছে। স্বাধীন তদন্ত কমিশনসহ আইনে সুস্পষ্ট অনেক নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেসব বাস্তবায়ন করা গেলে কথায় কথায় গুম হত্যাকা- কমে আসত। রাষ্ট্র সমাজে এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে চায়। যাতে সরকার যারা পরিচালনা করেন তাদের দুর্নীতি, তাদের অপকর্ম নিয়ে মানুষ জাগ্রত হয়ে প্রতিবাদ করতে না পারে। কেন জানি না, রাষ্ট্র পরিচালনা যারা করেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ বাহিনীর কাছে নতজানু অবস্থান নিয়েছেন।’

জানুয়ারি ২০১৯ থেকে এ বছরের ২৫ জুন পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ৫৩৫ জন। এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে ৪৮১ জনের, শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের এবং গুলি, অসুস্থ ও গুলিবিদ্ধ লাশ (অন্যান্য) উদ্ধার ৩১ জনের। এর মধ্যে গত সাড়ে পাঁচ মাসেই ১১ জন নির্যাতনের ফলে নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবস ২০২০-এর প্রাক্কালে সরকারের কাছে নির্যাতনবিরোধী কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। ফোরাম মনে করে, বিদ্যমান দায়হীনতা ও বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সংবিধান ও মানবাধিকারের মানদ- এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান অতীব জরুরি। অন্যথা কতিপয় সদস্যের অপরাধ প্রবণতা ও স্বেচ্ছাচারিতা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ক্রমান্বয়ে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, যা রাষ্ট্রের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক হবে না।

এক বিবৃতিতে এইচআরএফবি জানায়, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি এ সংক্রান্ত সনদের আওতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা শেষে কমিটি বাংলাদেশ সরকারকে ৭৭টিরও বেশি সুপারিশ প্রদান করে, যার মধ্যে অন্যতম যে বা যারা এ ধরনের আচরণ ও নির্যাতন করছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় বা নির্দেশনার দায়-দায়িত্ব নিশ্চিত করা; নির্যাতনের অভিযোগ কিংবা আটক ও আটকাবস্থায় মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা; একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা এবং নির্যাতনবিরোধী আইন অনুযায়ী তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া; ডাক্তারি পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা এবং সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা; নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) ২০১৩ আইন সংশোধন করে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিধান সংযুক্ত করা; গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের মাধ্যমে ‘গুম’কে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং এ সনদটি স্বাক্ষর করা ইত্যাদি। সর্বোপরি কমিটি তার সমাপনী পর্যবেক্ষণে নির্যাতন বন্ধে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সুষ্পষ্ট নির্দেশনার ওপর জোর দেন। দুঃখজনকভাবে সত্যি, গত এক বছরে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করছি না, বরং আইন প্রয়াগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা নির্যাতন ও এর ফলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো দৃশ্যমান প্রচেষ্টা নেই, বরং এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়হীনতা চলমান রয়েছে।

(আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত)

No comments